ছাগল চড়িয়ে রোজিনার ভাগ্য বদলের গল্প
নজরুল ইসলাম :
অভাবের কারণে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠেই স্কুল ছেড়েছিলেন। ১৪ বছর বয়সে বাধ্য হয়েছিলেন বিয়ের পিঁড়িতে বসতে।
দিনমজুর স্বামীর সংসারে এসেও অভাব পিছু ছাড়ছিল না। একবেলা খাবার জুটলেও অন্য বেলা উপোস থাকতে হতো। এরই মধ্যে স্বপ্ন দেখেন নিজে কিছু করার। এ অবস্থায় ২০০০ সালে ছাগল পালন শুরু করেন। দেখতে দেখতে ছোটখাটো একটি খামার হয়ে যায় তাঁর।
সংগগ্রামী মানুষটির নাম রোজিনা বেগম। বাড়ি শেরপুরের নকলা উপজেলার নারায়নখোলা প্রামে। গত ১৫ বছরে ৪৫৫টির বেশি ছাগল বিক্রি করে আয় করেছেন অন্তত ত্রিশ লাখ টাকা। শুধু নিজের ভাগ্য বদল করে থেমে থাকেননি। প্রতিবেশী ও আশপাশের গ্রামের অভাবগ্রস্ত নারীদেরও পথ দেখিয়েছেন তিনি। নারায়নখোলাসহ আশপাশের তিনটি গ্রাম মিলিয়ে প্রায় ৩০০ নারী এখন ছাগল পালন করছেন। রোজিনার মতো তাঁদেরও বাড়িতে এখন ছাগলের খামার।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার খাগরাটা গ্রামে ১৯৭৬ সালে জন্ম রোজিনা বেগমের। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ১৯৯০ সালে বাবা নেওয়াজ উদ্দিন কিশোরী রোজিনাকে বিয়ে দেন শেরপুরের নকলা উপজেলার নারায়নখোলা প্রামের হাকিম উদ্দিন শেখের ছেলে মো. রফিকুল ইসলামের সঙ্গে।
বাবার বাড়ির পর স্বামীর বাড়িতে এসেও অভাব, দারিদ্র্য মেনে নিতে পারেননি রোজিনা। কিছু করার স্বপ্ন থেকে শুরু করেন কাপড় বিক্রির ব্যবসা। এতে কিছু আয় হয়। তিন মাসের লাভের টাকায় কেনেন ৫টি হাঁস ও ৫টি মুরগি। ৯ মাস পর সেগুলোর বাচ্চা বিক্রি করে এবং কাপড়া বিক্রির জমানো টাকায় একটি দেশি জাতের ছাগল কেনেন রোজিনা। পাশাপাশি সেলাই মেশিনে কাপড় তৈরির কাজও শুরু করেন।
অনেক কষ্ট করে রোজিনা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। শুধু নিজে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বললে ভুল হবে, রোজিনা আশপাশের তিনটি গ্রামের তিন শতাধিক নারীকে সুন্দরভাবে বাঁচার পথও দেখিয়েছেন। সারে রাতুল নামে একটি ছেলেও হয়েছে। ছেলেকে বিয়ে করিয়ে এখন সুখেই রয়েছেন রোজিনা।
ছয় মাস পালনের পর দুইটি ছাগলে ছয়টি বাচ্চা দেয়। কাপড় বিক্রি ও সেলাই করেও ৫ হাজার ৮০০ টাকা জমা হয়। এই টাকা দিয়ে ২০০২ সালে আরও দুটি ছাগল কেনেন। বছর না ঘুরতেই কেনা ছাগল দুটিও বাচ্চা দেয় চারটি। এভাবে বাড়তে থাকে ছাগলের সংখ্যা। ২০১৬ সালে ছাগল বিক্রি করে আয় করেন ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ওই টাকা দিয়ে ৫৮ শতক জমি বন্ধক নেন। চলতি বছর ৪০টি ছাগল বিক্রি করে রোজিনা আয় করেছেন ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা। বর্তমান তাঁর খামারে ৫০টি ছাগল আছে। লাভের টাকায় খড়ের ঘরের জায়গায় টিনের ঘর করেছেন রোজিনা। কিনেছেন ৩৩ শতক জমি। আছে একটি গাভিও। এখন ছাগল পালন করে বছরে দেড় লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন।
রোজিনার সাফল্য দেখে প্রতিবেশী নারীরাও ছাগল পালনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। রোজিনা তাঁদের ছাগল পালনের পরামর্শ দেন। ধীরে ধীরে আশপাশের কয়েক গ্রামের দুই শতাধিক নারী ছাগল পালনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।
নারায়খোলা গ্রামের সিমা আক্তার জানান, এখন নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য স্বামীর কাছে হাত পাততে হয় না। রোজিনার কাছে ছাগল পালন শিখে তিনি এখন নিজে বছরে ৫০-৬০ হাজার টাকা আয় করছেন। ছাগল বিক্রির লাভের টাকায় ২৮ শতক জমি বর্গাও নিয়েছেন। গাছপালায় ঘেরা বাড়িতে শাকসবজি চাষ করছেন।
একই গ্রামের গোলাপী বেগম জানান, দেশের প্রতিটি গ্রামের রোজিনার মতো উদ্যোক্তা থাকলে আমাদের দেশের নারীরা আর পিছিয়ে থাকবে না। আমিও তাকে অনুসরণ করে ছাগল পালনের চেষ্টা করছি।
ওই গ্রামের ছাগল পালন করে স্বাবলম্বী হওয়া ঋতা রাণী বলেন, ‘আগে ঘরে বসেছিলাম। রোজিনা দিদির পরামর্শে তাঁর খামার থেকে একটা ছাগল কিনে পালন শুরু করছি। এখন ১০টা ছাগল আছে। ছাগল বেচা টাকায় সংসার ভালো চলোছে। স্বামীকে একটি জুতার দোকান নিয়ে দিয়েছি। ছেলেমেয়েরাও স্কুলে পড়ছে।’
চৈথট্র গ্রামের রোজিনার বান্ধবী আঞ্জুমানারার সংসারে অভাবের কারণে প্রায়ই ঝগড়া লাগত। এসব থেকে মুক্তি দিয়েছে ছাগল পালন। তিনি বলেন, ছাগল পালন করতে বেশি জায়গার দরকার হয় না। অল্প টাকাতে হয়। তিন হাজার টাকা দিয়ে রোজিনার পরামর্শে তিন বছর আগে ছাগল পালন শুরু করেছেন। বিক্রি বাদে এখন তাঁর ১০টি ছাগল আছে। ছাগল বিক্রির টাকায় স্বামী কাপড়ের ব্যবসা করছেন। পরিবারের সবার প্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি।
সফল এই নারী উদ্যোক্তা রোজিনা বেগম বলেন, দেশি জাতের ছাগল বছরে দুইবার বাচ্চা দেয়। একটি ছাগল সর্বোচ্চ চারটি বাচ্চা দেয়। ছয় মাস বয়সী একটি ছাগল বিক্রি হয় আট থেকে দশ হাজার টাকায়। একটি ছাগল ছয় মাসে খড়, কাঁচা ঘাস, ভুসি খায় দুই হাজার টাকার। ছাগল বিক্রির লাভের টাকায় জমি কিনেছেন। বাড়ি করেছেন। গাভিও পালন করছেন। সব মিলিয়ে ছাগলের বদৌলতে স্বামীকে নিয়ে সুখের সংসার করছেন। অনেকেই এখন ছাগল পালনের পরামর্শ নিচ্ছেন। বাড়িতে এসে পোষার জন্য বিভিন্ন জায়গার লোকজন ছাগল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আরও জানান, নারীদের গার্মেন্টসে চাকুরি করায় চেয়ে ছাগল পালন করে সংসার চালানো অনেক ভালো।
বৃহত্তর সন্ধানপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুর মিয়া বলেন, রোজিনার সংগ্রামী জীবনের গল্প তিনি জানেন। অনেক কষ্ট করে রোজিনা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। শুধু নিজে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বললে ভুল হবে, শোনেছি তার স্বামীরবাড়ি গ্রামের আশপাশের তিনটি গ্রামের দুই শতাধিক নারীকে সুন্দরভাবে বাঁচার পথও দেখিয়েছেন।
No comments