বিপন্ন উদ্ভিদ গাদিলাপাতার সন্ধান মিললো শামছু মাস্টারের বাগানে
মো. নজরুল ইসলাম :
বর্ষার অসময়ের প্রচন্ড খরতাপের সকালবেলা। কয়েক বছর পর ভালো একটি ফিচার নিউজের খোঁজে মধুপুর শালবনে। শালবনের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা সরু মেঠো পথ, হয়তো কোনো লোকালয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে।
সেসব লোকালয়ের মানুষেরাই বুনেছে বিদেশী আকাশমনি ও ইউক্যালিপটাস গাছ। পাট কাটার পর সেসব জমিতে লাগানো হচ্ছে এখন আমন ধানের চারা। একসময় হয়তো এসব খেতেও ছিল শালগাছ, ধীরে ধীরে শালবনের এলাকা কমে আসছে, বাড়ছে চাষের খেত।
শালবনের মধ্য দিয়ে নিত্যচলাচল, গবাদিপশুর অবাধ বিচরণ, কবিরাজদের গাছপালা সংগ্রহ, নারীদের গাদিলাপাতা তোলা, শীত শেষে চৈত্রদিনে ঝরা শালপাতা কুড়ানিদের পাতা কুড়ানো, ঘরবাড়ি বানানোর জন্য গাছ কাটা, ধান-কলা চাষ করা, অপরিকল্পিতভাবে রিসোর্ট ও কলকারখানা স্থাপন সব মিলিয়ে গাজীপুর ও টাঙ্গাইলের শালবনের অধিকাংশ এলাকার এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।
বন বিভাগ ফাঁকা হয়ে যাওয়া শালগাছগুলোর জায়গায় নতুন করে লাগাচ্ছে ইউক্যালিপটাস, সেগুন আর আকাশমণি। হয়তো বনভূমির সরকারি মালিকানাটুকু দখলে রাখার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। না হলে সেটাও হয়তো কলাখেত হয়ে যাবে কদিন পরেই। এর পরিণতিতে শালবন থেকে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক উদ্ভিদ প্রজাতি।
বনের নীরবতা ও পাখপাখালির কিচিরমিচির, ঝিঁঝি পোকার ঝিঁ-ঝিঁ-ঝিঁ-ঝিঁ শব্দ কিছুই যেন কানে আসছে না; বরং মাথার ওপরে থাকা সূর্যের ছোঁয়া যেন কোথাও কোথাও শালবনের মাটি পেয়ে খিলখিলিয়ে হাসছে। কিছুদিন আগেও যেখানে স্যাঁতসেঁতে ঘন বনের ভেতরে দোর্দান্ত প্রতাপে ঝাঁপিয়ে বাড়তে দেখেছিলাম লতাঢেঁকিয়া ফার্নের গাছ, আজ সেখানে সেগুলোর মরণাপন্ন অবস্থা দেখে মনটা মুচড়ে উঠল।
মধুপুর শালবনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হটাৎ মনে পড়ল পাশের ঘাটাইলের রসুলপুর গ্রামের শামছুল আলম মাস্টারের কথা। তিনি এক সময় এ প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন তার বাগানে বিলুপ্ত গাদিলাপাতা গাছ রোপন করেছেন। ফিরে চলরাম শামছু মাস্টারের বাগানে বিপন্ন গাদিলা পাতার সন্ধানে।
রসুলপুর শামছুল আলম দাখিল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মো. শামছুল আলম মাস্টারের বাগানে দেখা মিলল আনা গোটা ও বেহুরগোটাগাছের। গাদিলা পাতাগাছ পেলাম একটা, এটা নাকি এখন বিলুপ্ত। যেসব গাছ শালবন থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে বা হারিয়ে যাচ্ছে, সেসব গাছের কী হবে?
মো. শামছুল আলম মাস্টার জানান, তার সত্তোর দশকের একটি পুরোনো পুকুরপাড়ে আনা গোটা, বেহুরগোটাগাছ ও গাদিলা পাতাগাছ দেখতে পেয়ে খুব যতœ নিয়ে এগুলোকে বড় করেছেন। আনাইগোটা গাছে আনাইও ধরেছিল। আনাই ও বেহুরগোটা ফল খব সুমিষ্টি। অতিতের রাখাল বালকদের প্রধান খাবারই ছিল এই আনাই ও বেহুরগোটা ফল। আর তামাক হিসেবে ছিল গাদিলা পাতার বিড়ি। তিনি আরও জানান, আশি দশকে সরকার গাদিলা পাতার বিড়ি নিষিদ্ধ করলে বিলুপ্ত হতে থাকে গাদিলা পাতা গাছ।
বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ গাদিলা। এই গাছের পাতা কিছুটা সরু ও লম্বা আকারের, বহু শিরায় বিন্যস্ত। গাদিলাগাছের চেয়ে গাদিলাপতা বেশি পরিচিত। এই পাতা ব্যবহৃত হয় হস্তশিল্পের পণ্য তৈরিতে। গাদিলাগাছের পাতা সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াাজাত করে তা হস্তশিল্প পণ্য তৈরিতে ব্যবহারের উপযোগী করা হয়। এই গাদিলাপাতা সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজের প্রতিটি পর্যায়ে জড়িত থাকেন গ্রামের নারীরা।
ইউনিভার্সিটি অব ফ্রেইবার্গ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন গবেষক মধুপুর জাতীয় উদ্যানের শালবনে ২০১৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত গবেষণা করে শালবনে ৯৫টি পরিবারের ৩৮৫ প্রজাতির উদ্ভিদের অস্তিত্ব নিশ্চিত করেন। গবেষক মো. রায়হানুর রহমান ও তাঁর সাথি গবেষকেরা ২০১৭ সালে প্রকাশিত তাঁদের গবেষণাপত্রে ১৪০ প্রজাতির বৃক্ষ, ৪৮ প্রজাতির গুল্ম, ১৩৫ প্রজাতির বিরূৎ, ৪৬ প্রজাতির লতা, ৯ প্রজাতির ফার্ন, ৫ প্রজাতির পরাশ্রয়ী ও ২ প্রজাতির পরজীবী উদ্ভিদ প্রজাতি শালবনে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
এগুলোর মধ্যে ২১২ প্রজাতির গাছের ঔষধি গুণ রয়েছে। শালবনের প্রায় ৩ শতাংশ প্রজাতির গাছ বিপন্ন ও ২ শতাংশ উদ্ভিদ রয়েছে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। ভুতুম, পিরালু কাঁটা, বনখেজুর বা খুদিখেজুর, বেত, গাদিলা, জংলিকুল বা শিয়ালকুল, শালপান, বানরকলা ইত্যাদি বর্তমানে শালবনের বিপন্ন গাছ।
মধুপুর শালবনে গাদিলা গাছ বিলুপ্ত হলেও গাজীপুরের ভাওয়ালের বনাঞ্চলের শ্রীপুরে বিভিন্ন গজারি বনে দেখা মেলে গাদিলাগাছ। আর এই অঞ্চলের বনের আশপাশে বসবাসকারী শত শত নারী গাদিলাপাতা সংগ্রহের কাজ করেন। এরপর সেটা প্রক্রিয়াজাত করে পাইকারের হাত পর্যন্ত পৌঁছে দেন তাঁরা। পাতা বিক্রির টাকায় ওই নারীরা যুগ যুগ ধরে নিজেদের সংসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাদিলাপাতা শুকানোর পর সেটি কুয়াশায় ভেজানো হলে এই পাতার স্থায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। এটি সহজে ছেঁড়েও না, এমনকি ভাঙেও না।
রসুলপুর (আমতলা) গ্রামের প্রবীন ব্যক্তি মো. হাকিম উদ্দিন (৬৫) জানান, তাঁদের গ্রামে সংগ্রামের আগে প্রায় সব পরিবারে গাদিলাপাতা সংগ্রহের কাজ চলত। আগে এসব পাতা দিয়ে লোকজন বিড়ি বানাত। রসুলপুর (হামকুড়া) গ্রামের মৃত শফিকুল ইসলাম ও সেকান্দর আলি গাদিলা পাতার বিড়ির এজেন্ট ছিল। তাদের বাড়িতে বিড়ি ভরে আমি গারোবাজার, মোটেরবাজার ও সাগরদিঘিসহ বিভিন্ন হাটে পাতার বিড়ি ব্রিক্রি সংসার চালাতাম।
একই গ্রমের আরেক প্রবীন ব্যক্তি মো. আব্দুর রহমান (৭০) জানান, আমরা অনেকেই গাদিলা পাতার বিড়ি খেয়েছি। পাতার বিড়ির ঘ্রাণ ছিল খুব ভালো। ভারত থেকে মসলা এনে পাতার বিড়ি হতো। প্রতি প্যাকেট বিড়ি ৫/৬ পয়সা দামে কিনতাম। তিনি জানান, এখনকার ছেলেরা জানেই না পাতার বিড়ি কী? তারা দেখেই নাই গাদিলা পাতা। আমাদের গ্রামে মাস্টারে বাগানে গাদিলা গাছ দেখতে অনেকই আসেন।
এই গ্রামের নূরজাহান বেগম (৪৫) জানান, পাতা সিদ্ধ করে রোধে শুকিয়ে মাপমত কেটে মসলা ভরে ভাঁজ করে মাথাটা সতো দিয়ে পেঁচিয়ে ২৫টি করে প্যাকেট করা হতো।
জয়নাতলী গ্রামের আব্দুল মান্নান জানান, আমাদের বাড়িতেও গাদিলা পাতার বিড়ি তৈরি হতো। কাগজের বিড়ি আসার পর পাতার বিড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। এখান যেহারে বিড়ি-সিগারেটের দাম বাড়ছে, এইহারে তখন বিড়ির দাম বাড়লে মানুষ বিড়ি খাওয়াই ছেড়ে দিতো।
তবে এখনও অন্য এলাকায় এই পাতার বহুবিধ ব্যবহার আছে। বিশেষ করে কৃষকের মাথাল তৈরিতে এই পাতার ব্যবহার হচ্ছে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি। তবে এই পাতা এখন ঝুড়িসহ বিভিন্ন হস্তশিল্প পণ্য তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি রিসোর্টের অন্দরসজ্জাতেও গাদিলাপাতার ব্যবহার করা হচ্ছে।
No comments