শীতল পাটির ঐতিহ্য ধরে রেখেছে দেলদুয়ারের পাটিশিল্পীরা
মাসুদ রানা, দেলদুয়ার :
বহুকাল ধরে ঐতিহ্যের সাথে শীতল পাটি তৈরি করে আসছে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাটি শিল্পীরা ।
এসব পাটি গুনে মানে উন্নত ও আকর্ষণীয় ডিজাইনের হওয়ায় কালক্রমে দেশজুড়েই জনপ্রিয়তা অর্জন করে । অথচ আধুনিক যুগে এসে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে শীতল পাটির কদরে অনেকটাই ভাটা পড়ে । ফলে বিপাকে পড়ে এ অঞ্চলের পাটি শিল্পীরা । তবে পাটি তৈরির কাজ যেন তাদের রক্তে মিশে আছে । তারা শত কষ্টের মাঝেও বাব-দাদার এ পেশাকে বুকে লালন করে আসছে ।
সে কারনে সকল প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে পাটি তৈরির মধ্যে দিয়ে আজও শীতল পাটির ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন এ অঞ্চলের পাটি শিল্পীরা । এ উপজেলার শিল্পীরা অনেক দরদ দিয়ে মনের সব রং ঢেলে নিপুন হাতে তৈরি করেন আরামদায়ক ও টেকসই শীতল পাটি ।
বর্তমানে আধুনিকতার যাঁতাকল থেকে বেড়িয়ে এসে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াসে পুরো উদ্যামে নিয়ে শীতল পাটির তৈরির কাজ করছেন এ অঞ্চেলের পাটিকররা । এ উপজেলার শীতল পাটি গুণে মানে অনণ্যা হওয়ায় নজর কারছে বর্তমানে বিভিন্ন অনলাইন শপে । সেখান থেকে পছন্দশই শীতল পাটি সংগ্রহ করছে ক্রেতারা । এছাড়া উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের হিংগানগর কামান্নাপাড়া লোকনাথ মন্দির এলাকায় সপ্তাহে শুক্রুবার ও মঙ্গলবার দুই দিন বসে পাটি বিক্রির হাট । এ হাটে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাটি কিনতে আসেন ব্যসায়ীরা ।
জানা গেছে, যুগ যুগ ধরে অনেক যতœসহকারে শীতল পাটি তৈরি করে আসছে এ অঞ্চলের পাটিকররা । তাদের তৈরি এসব শীতল পাটি সারা দেশেই জনপ্রিয় । একসময় গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে শীতল পাটির কদর থাকলেও বর্তমানে আধুনিকতার যাঁতাকলে পড়ে ঐতিহ্যবাহী এ শীতল পাটির কদর অনেকটাই কমে যায় ।
অথচ পূর্ব পুরুষের এ পেশা টিকিয়ে রাখতেই পুরো উদ্যোমে কাজ করে যাচ্ছে এ অঞ্চলের পাটি শিল্পীরা । বর্তমানে নানা প্রতিকূলতাকে পিঁছনে ফেলে শীতল পাটি তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছে তারা। এ অঞ্চলে তৈরি শীতল পাটি দৃষ্টিনন্দন,টেকসই, আরামদায়ক ও উন্নতমানের বৈশিষ্ট্যর দাবী রাখে বলে সারা দেশেই এর জনপ্রিয়তা রয়েছে ।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের হিংগানগর, গোমজানি ও এলাসিন ইউনিয়নের সিংহরাগী গ্রাম সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে ঘরে ঘরে চলছে পাটি বুননের কাজ । পাটিকর তাদের দক্ষ হাতের গাঁথুনি দিয়ে অনেক আকর্ষণীয় করে তৈরি করছে প্রতিটি পাটি । এসব পাটি তৈরির প্রধান কাঁচামাল হলো এক ধরনের গুন্ম বা মুত্রা জাতীয় উদ্ভিদ।
পাটি তৈরি করা হয় বলে ওই উদ্ভিদটি এ অঞ্চলে পাটিবেত হিসেবে পরিচিত লাভ করে । এ অঞ্চলের পাটিশিল্পের বিশাল এলাকা জুড়ে দেখা যায় পাটিবেতের চাষ । এসব পাটি বেত প্রত্রিয়াজাত করে পাটি তৈরির জন্য উপযোগি করে দেন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা । পাটি তৈরির মূল কারিগর হলেন পরিবারের নারী সদস্যরা । নারীরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পাটি বুননের কাজ করেন ।
পাটি বুননের পাশাপাশি সাংসারিক কাজকর্মও করেন তারা । ফলে প্রতিটি পাটি তৈরি করতে একজন নারীর সময় লাগে ৩ থেকে ৭ দিন । এসব পাটির বেশির ভাগই উন্নতমানের শীতল পাটি । আর এসব শীতল পাটির চাহিদা সারা বছর থাকলেও গরমে চাহিদা বহুগুনে বৃদ্ধি পায় । সে সময় শীতল পাটির যোগান দিতে দিন রাত কাজ করেন পাটিকররা । স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৫ হাজার পরিবার এই পাটি শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে । আধুনিকযুগে পাটির শিল্পের দুর্দিনে অনেকেই পেশা বদল করেছে বলেও জানা গেছে ।
তবে আটিয়া ইউনিয়নের বৃহত্তর হিংগানগর গ্রামের বিভিন্ন পাড়ায় সব চেয়ে বেশি পাটি তৈরি হয় বলে হিংগানগর গ্রাম ঘীরে গড়ে ওঠেছে পাটি হাট । সপ্তাহে শুক্রুবার ও মঙ্গলবার দুই দিন বসে পাটি হাট । এ অঞ্চলের পাটিকররা তাদের পাটির পসরা সাজিয়ে বসেন হাটে এলাকায়। বেলা ১১ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত চলে পাটি ক্রয়-বিক্রয়ের ধুম । সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাটি কিনতে আসেন ব্যবসায়ীরা । এ অঞ্চলে প্রতিটি পাটির মান অনুযায়ী ৮ শ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত পাইকারী মূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে । এসব পাটির খুচরা মূল্য রয়েছে ১০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা । এ উপজেলার বেশিরভাগ পাটি স্থানীয় এ হাটেই বিক্রি হয়ে থাকে । এছাড়া গ্রামে গ্রামে গিয়ে কিছু পাটি খুচরা মূল্যে বিক্রি করেন পাটিকররা।
হিংগানগর কামান্নাপাড়া গ্রামের পাটি শিল্পী বেলা রানী দে(৬৫), ও চন্দনা রানী দে (৩২) জানান, পরিবারের পুরুষ সদস্যরা শুধু পাটিবেত কেটে বেতি তৈরি করে দেন। পরে নারীরা বেতিতে রং দেওয়া সহ পাটি বুননের সব কাজ করে থাকেন । সাংসারিক কাজের পাশাপাশি প্রতিটি পাটি তৈরিতে সময় লাগে প্রায় ৩ থেকে ৭ দিন । আর এসব পাটির বেশির ভাগই শীতল পাটি । তবে গরমে শীতল পাটি তৈরি কাজে চাপ থাকে । এসময় পাটির চাহিদা বেড়ে যায় । সে কারনে রাতেও কাজ করা লাগে ।
একই গ্রামের পাটি শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট জুরান চন্দ্র দে (৫২),কেশব চন্দ্র দে(৭০) ও গোপাল চন্দ্র দে(৫৩) জানান, পরিবারের পুরুষ সদস্যরা পাটিবেত সংগ্রহ করে বেত থেকে বেতি তৈরি করে থাকে । পরে নারীরা পাটি তৈরি করে দিলে তা হাটি নিয়ে বিক্রি করে দেন ।বর্তমানে তাদের নিকট থেকে পাটি কিনে আনেকেই অনলাইনে শপে উচ্চ মূল্যে ব্যবসা করেন বলেও জানান তারা । তবে এ অঞ্চলের শীতল পাটির সুনাম রয়েছে বহুকাল থেকেই । পাটিকররা আরও বলেন , আধুনিক যুগে শীতল পাটির কদর কমে যাওয়া এ পেশা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে । এমন অবস্থায় এ শিল্পটি টিকিয়ে রাখতে সরকারী সহযোগিতা কামনা করছেন তারা।
No comments