ঐতিহ্য হারাচ্ছে দেলদুয়ারের ৪১৫ বছেরর পুরানো আতিয়া মসজিদ
মাসুদ রানা, দেলদুয়ার:
যুগ যুগ ধরে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন স্থাপনার অন্যতম নির্দশন টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার আতিয়া জামে মসজিদ ।
একসময় ইতিহাস ঐতিহ্যে বহনকারী ওই মসজিদটি বাংলাদেশ সরকারের দশ টাকার নোটে স্থান পেয়েছিল । বর্তমানে কোন টাকার নোটেই এর ছবি দেখা যাচ্ছে না । অযত্ন অবহেলায় মসজিদটি তার সৌন্দর্য হারিয়ে প্রায় ধ্বংসের পথে এ যেন দেখার কেউ নেই ।
অথচ অযত্ন অবহেলায় অস্তিত্ব হারানোর আশংকায় পড়েছে ৪১৫ বছরের পুরানো ওই ঐতিহ্যবাহী আতিয়া জামে মসজিদটি ।
মুসলমানদের মধ্যে যুগের ইতিহাস ঐতিহ্যে আতিয়া জামে মসজিদের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে । বর্গাকৃতির গম্বুজবিশিষ্ট লাল ইটের তৈরি মসজিটিতে রয়েছে চমৎকার স্থাপত্যশৈলী । মসজিদের পূর্ব ও উত্তর দেয়ালে রয়েছে চমৎকার সব পোড়ামাটির নকশা । বারান্দার পূর্ব দিকে অপেক্ষাকৃত ছোট তিন গম্বুজ বিশিষ্ট বারান্দায় রয়েছে তিনটি প্রবেশ দ্ধার । মসজিদের কেবলা দেয়ালে তিনটি অলঙ্কৃত মেহরাব রয়েছে ।
প্রাচীনতম স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নির্দশন ওই মসজিদটির সঠিক রক্ষণা—বেক্ষণের অভাবে দিন দিন ঐতিহ্য হারাচ্ছে বলে জানা গেছে । বিগত ২০২৩ সালের শেষভাগে মসজিদটিতে সাময়িক চুনকাম ও রংয়ের কাজ করা হয়েছে জানিয়ে স্থানীয় মুসল্লীরা বলেন মসজিদটির চুনকাম ও রংয়ের কাজ নিম্নমানের হওয়ায় মাত্র ৬ মাসেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । এছাড়া একসময় বজ্রপাতে মসজিদের একটি মিনার আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হলেও তার কাজটিও সঠিকভাবে করা হয়নি ।
দায়সারাভাবে ভেঙ্গে যাওয়া মেঝের প্লাস্টার করা হয়েছে । ঐতিহ্যবাহী ওই মসজিদটির রক্ষণা—বেক্ষণ কাজ নিয়ে এমন নানা অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় মুসল্লীদের । সাঠিকভাবে রক্ষণা—বেক্ষণের অভাবে মসজিদটি প্রায় ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে বলেও জানায় তারা। এভাবে চলতে থাকলে একসময় মসজিদটি তার অস্তিত্ব হারাতে পারে বলেও আশংকা করা হচ্ছে । অথচ একসময় মসজিদটির ঐতিহ্যর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ টাকা মূল্যমানের নোটে মসজিদটির ছবি মুদ্রণ করা হতো। সে কারনে সেসময়ে দেশ ও দেশের বাহিরের সবার নিকট মসজিদটির পরিচিতি ছিল ব্যাপক ।
অথচ কালক্রমে অযত্ন অবহেলায় মসজিটির ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । দেয়ালের পুরুতে শেওলা ধরে মসজিদটির প্রকৃত রং ও কারুকার্য মুছে যাচ্ছে । দেয়ালে খোদাই করা নকশাগুলোও অনেক মুছে যাচ্ছে । ফলে মসজিদটির প্রকৃত সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে । জরুরী ভিত্তিত্বে সংস্কার করা না হলে মসজিদটি একসময়ে পুরোপুরি তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলবে । দেশের প্রাচীনতম স্থাপত্যশৈলীর এক অন্যতম নির্দশন হলো আতিয়া জামে মসজিদ । ঐতিহ্যবাহী ওই মসজিদটি উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের আটিয়া গ্রামে অবস্থিত । আকষর্ণীয় কারুকার্যে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন আতিয়া জামে মসজিদ সহজেই দর্শনার্থীদের নজর কারে । তুলনামূলকভাবে আকারে ছোট ওই মসজিদটি দেশের প্রাচীন স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ।
মসজিদটির প্রবেশ পথের মূল ফটক থেকে জানা গেছে, তৎকালীন আতিয়া পরগণার শাসনকর্তা সাইদ খান পন্নী ১৬০৯ খ্রি. মসজিদটি নির্মাণ করেন । এরপর দিল্লীর একজন মহিলা বণিক রওশন খাতুন চৌধুরানী ১৮৩৭ খ্রি. এবং দেলদুয়ারের জমিদার আবু আহমেদ গজনবী খান ১৯০৯ খ্রি. মসজিদটির সংস্কারের কাজ করেন । পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার মসজিদটি পুরাকৃর্তি বা প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে অধিগ্রহণ করেন ।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত দর্শনার্থী ও স্থানীয় মুসল্লীগনের দাবী মসজিদটি জরুরী ভিত্তিত্বে সংস্কার করা করা প্রয়োজন । আটিয়ার প্রকৃত ইতহিাস বর্ণিত আতিয়ানামা ও বিভিন্ন পুস্তক থেকে জানা গেছে, আরবি ‘আতা’ শব্দ থেকে ‘আতিয়া’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে । যার অর্থ হলো ‘দান কৃত’ । সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ পঞ্চদশ শতকে হযরত শাহান শাহ্ বাবা আদম কাশ্মিরী (র.) কে টাঙ্গাইল জেলার জায়গিরদার নিয়োগ করেন । সে সময় ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং আনুষঙ্গকি ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি আফগান নিবাসী কররানী শাসক সোলাইমান কররানীর কাছ থেকে সংলগ্ন এলাকা দান বা ওয়াকফ হিসাবে পান ।
সে কারনে এ অঞ্চলটি আতিয়া নামে পরিচিতি পায় । কালক্রমে আতিয়া থেকে বর্তমানে এ অঞ্চল আটিয়া নামে পরিচিতি পেয়েছে । সে সময় হযরত শাহান শাহ বাবা আদম কাশ্মিরীর পরামর্শে সাইদ খান পন্নী নামক সূফীজীর এক ভক্তকে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর উক্ত আতিয়া পরগনার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন । সূফিজীর ভক্ত সাইদ খান পন্নীই ১৬০৯ সালে আতিয়া জামে মসজিদ নির্মান করেন । তৎকালীন এক প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ ওই মসজিটি নির্মানের পরিকল্পনা করে নির্মান কাজে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ।
দৃষ্টিনন্দন ওই মসজিদটি লাল ইট দ্বারা নির্মিত । মসজিদটির পূর্ব ও উত্তর পাশে^র দেয়ালে পুরুতে রয়েছে আকর্ষণীয় খোদাই করা নকশা অলংকিত । মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুইটি করে দরজা রয়েছে এবং পূর্ব দিকে তিনটি দরজা রয়েছে । মসজিদের দৈর্ঘ ১৮.২৯ মিটার ও প্রস্থ ১২.১৯ মিটার এবং দেয়ালের পুরুত্ব ২.২৩ মিটার। এছাড়া বারান্দার দৈর্ঘ ৩.৮২ মিটার ও প্রস্থ ৭.৫ মিটার ।
মসজিদটির চারকোনে ৪টি অষ্টকোণাকৃতির মিনার রয়েছে । মিনারগুলো ছাদের অনেক উপরে গিয়ে ছোট গম্বুজ আকৃতি ধারণ করছে । প্রধান গম্বুজটি আকারের যা আর্চ ভিত্তিক স্কুইঞ্চ পদ্ধতিতে নির্মিত হয়েছে । বারান্দায় স্থাপিত তুলানামুলক ছোট আকৃতির তিনটি গম্বুজ যা পেন্ডেন্টেটিভ পদ্ধতিতে নির্মিত হয়েছে । মসজিদটির নির্মাণ শৈলীতে সুলতানি ও মুঘল আমলের স্থাপত্যলরীতির সুস্পষ্ট নির্দশন রয়েছে । বর্তমানে আতিয়া জামে মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে রয়েছে । অথচ অযত্ন অবহেলায় ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে ৪১৫ বছরের পুরানো ওই মসজিদটি ।
আটিয়া গ্রামের ওসমান মিয়া (৮৫) জনান, সে ওই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন । রমজান মাস উপলক্ষে মসজিদে মুসল্লীদের উপস্থিতি বেড়েছে । তবে দিন দিন মসজিদটির সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে মসজিদটির প্রাচীন ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ।
আতিয়া জামে মসজিদের মোয়াজ্জেম রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে ওই মসজিদে চাকুরী করছেন। মসজিদটি প্রাচীনতম স্থপত্যশৈলীর এক অন্যতম নিদর্শন । মসজিদটির দ্রুত সঠিকভাবে সংস্কার কাজ না হলে একসময় মসজিদটির অস্তিত্ব পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে ।
আতিয়া জামে মসজিদ কমিটির সহ—সভাপতি আশরাফ হোসেন মানিক জানান, ৬ থেকে ৭ মাস আগে মসজিদটির কিছু কারুকার্য করা হয়েছে । কাজটি একবারেই নিম্নমানের হয়ছে । মাত্র ৬/৭ মাসের মধ্যেই যে চুনকাম ও রংয়ের কাজ করা হয়েছে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । এছাড়া দিন দিন মসজিদটির কারুকার্য নষ্ট হয়ে ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে । এভাবে অবহেলিত অবস্থায় থাকলে একসময় মসজিদটি পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলে জানান তিনি । এমন অবস্থায় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে তিনি মসজিদটির দ্রুত পুরোপুরি সংস্কাররের মাধ্যমে পুরানাকৃর্তিটি সংরক্ষণের দাবী জানান ।
No comments