দুইশত বছরের ঐতিহ্য টাঙ্গাইলের শাড়ি; জিআই স্বত্ব ফিরে পেতে আবেদন
বিশেষ প্রতিবেদক: টাঙ্গাইল
নদী, খাল, বিল, গজারীর বন-টাঙ্গাইলের শাড়ি তার গর্বের ধন। টাঙ্গাইলের সর্ব মহলে দীর্ঘ দিন যাবৎ এমন প্রবাদ প্রচলিত। দুই শত বছর যাবৎ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক টাঙ্গাইলের শাড়ি। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ায় শাড়ির উৎপত্তিস্থল টাঙ্গাইলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের দাবিকে ‘ভুয়া’ জানিয়ে জিআই বাতিল করে এটিকে বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে টাঙ্গাইলে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ব্যবসায়ী, কারিগর ও তাঁতিরা। এখনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে সমালোচনার ঝড়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, দুই শত বছর ধরে দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক টাঙ্গাইলের শাড়ি। ইতোমধ্যে যা নিজস্ব ঐতিহ্য বহন করে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সুনাম কুড়িয়েছে। টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের পন্য হিসাবে জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীসহ টাঙ্গাইলের সর্বস্থরের সচেতন মহল। টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক পলাশ চন্দ্র বসাক বলেন, ‘টাঙ্গাইলের শাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে শুনে আমরা হতবাক। মূলত এই তাঁতের শাড়ি আমাদের, এর জন্যই টাঙ্গাইল বিখ্যাত। কারণ শাড়ির উৎপত্তিস্থল এটি। এই ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক আমরাই। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কীভাবে এই শাড়িকে নিজেদের দাবি করলো, তা বুঝে আসছে না। এটি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা।
পাথরাইলের কৃষ্ণনগর গ্রামের তাঁতশ্রমিক মো. সেলিম বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তিস্থল টাঙ্গাইলই। বছরের পর বছর আমরা এই শাড়ি উৎপাদন করে আসছি। এটি আমাদের বাপ-দাদার সম্পদ। জিআই নিবন্ধন পেলে বাংলাদেশ পাবে। ভারত কীভাবে পায়? তাদের জিআই বাতিল করে আমাদের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানাই। কারণ এটি আমাদের কষ্টের ফসল।
টাঙ্গাইল শাড়ি টাঙ্গাইলের সৃষ্টি উল্লেখ করে পাথরাইলের তাঁত মালিক বাদল রাজবংশী বলেন, এটি টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য, বাংলাদেশের গর্ব। দুই শত বছর ধরে এই শাড়ি উৎপাদন করছি আমরা। ভারত এটি নিজেদের দাবি করলেই হলো। আমরা আমাদের ঐতিহ্য রক্ষায় আন্দোলন চালিয়ে যাবো।
টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন বলেন, শত বছর ধরে আমাদের বাপ-দাদারা এই শাড়ির ব্যবসা করে আসছেন। ভারতের দাবির কোনও যৌক্তিকতা নেই। তাদের দাবি অগ্রহণযোগ্য ও ভুয়া। বিষয়টি শোনার পর আমরা কয়েক দফা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বৈঠক করেছি। যাতে আমাদের ঐতিহ্যকে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ব পেতে ইতোমধ্যে আবেদন করা হয়েছেন। গত মঙ্গলবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর এ আবেদন করা হয়।
জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ি প্রকৃতপক্ষে যে কোন বিচারে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য দাবিদার। আমরা বিগত ৩ মাস ধরে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভের জন্য ডকুমেন্টেশন কার্যক্রম করেছিলাম। মূলত শাড়িটির ইতিহাস, এর সাথে সংশ্লিষ্ট মানুনের জীবন জীবিকার তথ্যটি, আড়াইশ’ বছরের ইতিহাসের তথ্যাদি সংগ্রহ করে ডকুমেন্টেশন তৈরি করে আবেদন করা হয়েছে। আবেদনটি ইতিমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করছি দ্রুতই টাঙ্গাইল শাড়ি নামে জিআই স্বীকৃতি পাবো।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি ভারতের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে করা একটি পোস্টে বলা হয়- ‘টাঙ্গাইল শাড়ি, পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত, একটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর মিহি গঠন, বৈচিত্র্যময় রং এবং সূক্ষ্ম জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত এটি এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। টাঙ্গাইলের প্রতিটি শাড়ি ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ সৌন্দর্য্যরে মেলবন্ধনে দক্ষ কারুকার্যের নিদর্শন।’ এরপর থেকে টাঙ্গাইলসহ সারাদেশে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
No comments