মধুপুরে এমডি-২ জাতের আনারস চাষে সফলতা
মো. নজরুল ইসলাম:
টাঙ্গাইলের মধুপুরের ফিলিপাইনের ‘এমডি টু’ জাতের আনারসের চারা রোপন হয়েছে। কৃষি বিভাগের মাধ্যমে এ চারা বিতরণ করা হয়। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এমপি’র বিশেষ আগ্রহে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাধ্যমে ফিলিপাইন থেকে এক লাখ এমডি টু জাতের আনারসের চারা আমদানি করা হয়।
এসব চারা কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করে উপজেলার মহিষমারা ও জয়নাতলী এলাকার ১০৭ চাষী তাঁদের জমিতে এ চারা রোপণ করেছেন। সাধারণ আনারসের চেয়ে এ আনারস অনেক বেশী সুমিষ্ট। এ ছাড়া বাগান থেকে কাটার পর সহজে পচন ধরে না। তাই পচন রোধে কোনো প্রকার রাসায়নিক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য অনেক ইতিবাচক হবে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। মধুপুর উপজেলার পুরো পাহাড়ী অঞ্চলের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন পাহাড়ী অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে আনারস উৎপাদন হয়ে থাকে। প্রতি বছরই শুধু মধুপুর উপজেলাতেই আনারস উৎপাদন হয় প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমিতে। বিপুল পরিমাণের এই আনারস প্রক্রিয়াজাতকরণ করে রপ্তানির মাধ্যমে মধুপুরকে প্রকৃতই ‘ক্যাপিট্যাল অব পাইনাপেল’ এ পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এ জন্যই রপ্তানিযোগ্য উন্নত জাতের আনারস আমদানি ও চাষীদের মাধ্যমে বিতরণের কাজ হাতে নিয়েছে সরকার। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অরণখোলা গ্রামের আনারস চাষী মজিবর রহমান মজি জানান, আমি দেড় বিঘা জমিতে এমডি টু জাতের আনারসের চারা লাগিয়েছি। শুনেছি আমাদের এ অঞ্চলে যে সব আনারস চাষ হয় তার চাইতে ফলন বেশী ও খুবই মিষ্ট হয়। সেই সাথে বাগান থেকে কাটার পর দীর্ঘদিন ঘরে রাখা যায় ।
তাই এই ফল বিদেশে রাপ্তানি করা যাবে। সকল দিকেই সুবিধা দেখে আবাদ করেছি। গাছের যে ভালো অবস্থা দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে ফলন অনেক ভালো হবে। এখন আগাছা পরিষ্কারের সময় আগাছা পরিষ্কারের জন্য বাগানে শ্রমিক দিয়ে কাজ করাচ্ছি। যদি বাজারে দাম ভালো থাকে আমরা কৃষকরা লাভবান হতে পারব। উপজেলার মহিষমারা গ্রামের আনারস চাষী ছানোয়ার হোসেন জানান, ইন্টারনেট ঘেঁটে তিনি জানতে পেরেছেন যে আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুণ থাকলে এমডি টু জাতের আনারসের ফলন ভালো হয়। তার সব গুণাগুণ মধুপুরের মাটি ও আবহাওয়ায় রয়েছে। তাই তিনি এ আনারস চাষে আগ্রহী হয়েছেন। প্রথম অবস্থায় এক বিঘা জমিতে এ চারা লাগিয়েছেন তিনি।
বিখ্যাত সুপার সুইড গোল্ডেন এমডি-২ ফিলিপাইনি জাত দেশে আনার উদ্যোগ নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। এটি দেশীয় জাতের মতো দ্রæত পচনশীল নয়, কাটাও নেই। তাই রফতানি উপযোগী। শুধু মধুপুর নয়, রাঙামাটিসহ পাহাড়ি অঞ্চলেও এই জাতের আনারস ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে বিনামূল্যে সাত লাখ চারা কৃষকের মধ্যে বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিএডিসির তত্ত্বাবধানে গ্রিন মাউন্ট ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল (নয়াপল্টন, ঢাকা) নামে একটি কোম্পানি এই চারা ফিলিপাইন থেকে আমদানি করে। এই চারার প্রায় সবই দেশে এনে কৃষকদের মধ্যে বিতরণও করা হয়েছে। যার বেশির ভাগই মধুপুরের কৃষক পেয়েছেন। প্রতিটি চারার দাম পড়েছে প্রায় ৭০ টাকা করে। সেই হিসেবে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়েছে সরকারের।
ফিলিপাইন থেকে আনা এসব চারা দেশীয় চারার মতোই বেড়ে উঠছে। চাষিরা এখন অপেক্ষায় আছেন কবে নাগাদ এই গাছে ফল ধরে। এই যখন অবস্থা তখন এমডি-২ জাতের আনারসের চারার ভালো-মন্দ দেখতে সরেজমিন ফিলিপাইন সফরে গেছেন কৃষি মন্ত্রণালয়, বিএডিসি (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পাঁচ কর্মকর্তা।
গত বৃহস্পতিবার রাতে বিএডিসির সদস্য পরিচালক (বীজ ও উদ্যান) মোস্তাফিজুর রহমান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রধান বীজতত্ত্ববিদ মোহাম্মদ আখতার হোসেন খান, বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ড. মো: মেহেদী মাসুদ, বিএডিসির উদ্যান উন্নয়ন বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্যান জাতীয় ফসল সরবরাহ ও পুষ্টি নিরাপত্তা উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মাসুদ আহমেদ ও বিএডিসির কাশিমপুর হর্টিকালচার সেন্টারের যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মাদ মাহবুবে আলম ফিলিপাইনে গেছেন বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই চারা মূলত পরীক্ষামূলকভাবেই লাগানো হয়েছে। এটি ফিলিপাইনে ভালো হলেও বাংলাদেশে কেমন হবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মাটি এবং পরিবেশের সাথে কতটুকু খাপ খাবে তা-ও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ। এক বা একাধিক কর্মকর্তার মুখে ‘এমডি-২ জাত খুবই ভালো’ তাতে বিশ্বাস রেখেই সাত লাখ চারা দেশে আনার সিদ্ধান্ত হয়।
গত ডিসেম্বরে এক লাখ চারার প্রথম চালান দেশে আসে। ওই মাসের মাঝামাঝিতে এই চারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মধুপুরে চাষিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। চারা বিতরণকালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প’র পরিচালক ড. মো: মেহেদী মাসুদ সাংবাদিকদের জানান, ‘এমডি টু জাতের আনারস রফতানিযোগ্য। আনারসের সাইজও ভালো। দেশীয় আনারসের তুলনায় অনেক বেশি মিষ্টি। ভিটামিন সি’র পরিমাণ দেশী আনারসের চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি।এ ছাড়া দেশীয় আনারসের চোখগুলো থাকে ভেতরের দিকে। নতুন এই জাতের আনারসের চোখগুলো থাকে বাইরের দিকে। ফলে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন অংশের অপচয় কম হয়। পোকার আক্রমণ কম হয়। এই আনারসে দেশীয় আনারসের মতোই ১২ মাসে ফলন আসে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় জাতের আনারসের চারা লাগানোর প্রায় ১৬-১৮ মাস সময় লেগে যায় ফল আসতে। ফিলিপাইনি জাতের লাগানো চারা দেশীয় জাতের মতোই বড় হচ্ছে। সুতরাং ১২-১৪ মাসে ফল আসবে- এমন কথা বলা হলেও সেটার সম্ভাবনা কম।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল বলেন, মধুপুরে ১০৭ জন কৃষকের মধ্যে পাঁচ লাখ ৮৯ হাজার ৫০০ চারা বিনামূল্যে বিতরণ করেছি। বাকি চারা রাঙামাটিসহ পাহাড়ি অঞ্চলে দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এ বছর মধুপুরে ছয় হাজার ৫৪২ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়েছে। গত বছর আবাদ কম ছিল। প্রতি হেক্টরে গড়ে ৪০ টনের মতো ফলন হয়। এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, মধুপুরের জাতগুলো ভাল। কিন্তু সংরক্ষণে সমস্যা। বিদেশে রফতানিতে বাধা হলো- এখান থেকে কন্টেইনারে ভরে দিলে সংশ্লিষ্ট দেশে যাওয়ার পথেই তা পচে যায়। এ জন্যই বিদেশী রফতানিযোগ্য ফিলিপাইনি জাত এমডি-২ আনা হয়েছে। চারা ইতোমধ্যে বড় হচ্ছে। এখন যে গ্রোথ মোটামুটি দেশীয় আনারসের মতোই। আগামী জুলাইতে হয়তো ফল আসবে। তখন দেখা যাবে স্বাদ গন্ধ কেমন।
বিএডিসির উদ্যান উন্নয়ন বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্যান জাতীয় ফসল সরবরাহ ও পুষ্টি নিরাপত্তা উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মাসুদ আহমেদ বলেন, সাত লাখ চারার মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ছয় লাখ ২৫ হাজার চারা চলে এসেছে। সরেজমিন গিয়ে এই জাত দেখে এনেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, সরাসরি এখনো যাওয়া হয়নি। করোনার কারণে ভিসা অনুমতি দেয়া হয়নি। সরেজমিন না দেখেই চারাগুলো দেশে চলে এলো- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যারা আগে এটা দেখেছেন, তাদের কাছে শুনে এই চারা আনা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে এখনো যাওয়া হয়নি।
মাসুদ আহমেদ জানান, প্রকল্পের টাকায় আনারসের চারা আনা হচ্ছে না। এটা কৃষি প্রণোদনা থেকে আনা হচ্ছে। আগে সরেজমিন না গিয়ে এখন কেন ফিলিপাইনে যাচ্ছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের টাকায় যাচ্ছি না। আমদানিকারক কোম্পানি সফর খরচ বহন করছে। কোম্পানি নিয়ে যাচ্ছে কেন- ওদের স্বার্থ কী? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএডিসির এই কর্মকর্তা বলেন, তারা নিয়ে যাচ্ছেন। কারণ ভবিষ্যতে হয়তো আরো চারা আনা লাগতে পারে। তাই ভিজিট করতে নিয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ড. মেহেদী মাসুদ জানান, ছয় লাখের বেশি চারা চলে এসেছে। সুপার সুইড গোল্ডেন এমডি-২ জাতের আনারসে ভিটামিন সি ৪ গুণ বেশি। এক্সপোর্টেবল ভ্যারাইটি। এটা হলে (উৎপাদন) বাংলাদেশ আনারস এক্সপোর্ট করতে পারবে।
এই জাতের অধিকাংশ মধুপুরে লাগানো হয়েছে। দারুণ হয়েছে। এটা বাংলাদেশের মধ্যে নজিরবিহীন হয়ে থাকবে; পদ্মা সেতুর মতো। এটা অসাধারণ জিনিস হয়ে থাকবে। লাগালাম তো মাত্র তিন মাস। ডিসেম্বর প্রথমে। বলা চলে ফেব্রয়ায়ারি থেকে লাগানো শুরু হয়েছে। বিএডিসির মাধ্যমে রাজস্ব ফান্ড থেকে এই চারা আনা হয়েছে। শুধু মধুপুর না, রাঙামাটিতেও এই চারা লাগানো হচ্ছে।
No comments