বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর প্রায় ৬১ শতাংশ কাজ শেষ
যমুনা নদীর উপর দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু' নির্মাণের কাজ চলছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের দুই প্রান্তে এ সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পের প্রায় ৬১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে জানান প্রকল্প কর্মকর্তা।
এই রেলসেতুটি চালু হলে ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের ২২টি জেলার সঙ্গে ট্রেন চলাচল সহজ হবে। এটি আন্তঃ-এশিয়া রেল সংযোগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডোর হিসাবেও কাজ করবে। উত্তরবঙ্গের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই রেল সেতু। এছাড়াও স্থানীয় সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির মনে করেন, সেতুটি উদ্বোধনের পর এলাকাবাসীর অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বাড়বে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, যমুনা নদীর দুই পাড়ে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে ৩০০ মিটার দূরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর নকশাসহ নির্মাণ ব্যয় প্রাথমিকভাবে ধরা হয়েছিল ৯ কোটি ৩৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। দেশের বৃহত্তম রেলসেতু নির্মাণে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) থেকে ৭ কোটি ২৪ লাখ ৩৩০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়ার কথা ছিল। ডিপিপি রিভিশনের প্রথম দফায় সেতুটির নির্মাণ ব্যয় ৭ হাজার ৪৭ কোটি টাকা বেড়ে প্রায় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা হয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলওয়ে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। প্রকল্পটি ২০২৪ সালের আগস্টের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
০.০৫ কিমি ভায়াডাক্ট, ৭.৬৭ কিমি রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ বাঁধ এবং লুপ ও সাইডিং সহ মোট ৩০.৭৩ কিমি রেললাইন নির্মাণ করা হবে ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাক সহ ৪.৮০ কিলোমিটার রেলওয়ে সেতুর উভয় পাশে। এই মেগা প্রকল্পে মোট বরাদ্দ প্রায় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। যার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। জাপানী ঠিকাদার IHI, SMCC, Obayashi Corporation, JFE এবং TOA কর্পোরেশন কাজটি সম্পাদন করছে।
প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ। মাসুদুর রহমান বলেন, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ৩৮টি ট্রেন চলাচল করছে। এই ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাক সেতুর কাজ শেষ হওয়ার পর এর উপর দিয়ে ৮৮টি ট্রেন চলাচল করবে। ট্রেনগুলি 100 থেকে 120 কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা বেগে চলবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশেই চলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর কাজ। শতাধিক শ্রমিক বিভিন্ন কাজ করছেন। কেউ করছেন পাইলিংয়ের কাজ, কেউ করছেন কোদালের কাজ। অন্য কাউকে ঢালাইয়ের কাজ করতে দেখা গেছে। বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর ৫০টি পিলারের মধ্যে ৩১টি এবং ৪৯টি স্প্যানের মধ্যে ১৫টির কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে 16তম স্প্যানের উপরিভাগের কাজ চলছে। এ ছাড়া বাকি ১৯টি পিলারের বিভিন্ন স্তরের ঢালাইয়ের কাজ চলছে।
প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক নাসির উদ্দিন বলেন, আমাদের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। আমরা বর্তমানে Jio ব্যাগ ডাম্প করছি। আমরা সাব কন্ট্রাক্টের কাজ করলেও এখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি। এখানে কাজ করতে পেরে আমি গর্বিত। এর আগে মেঘনা ও গোমতীতেও কাজ করেছি। যেভাবে কাজ চলছে তাতে আমরা আশা করছি নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ হবে।
মোঃ রেজাউল করিম নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, এখানে কাজ করে আমি খুবই সন্তুষ্ট। আমাদের কাজের মান ও মান খুবই ভালো। আমি মান ও নিরাপত্তার সাথে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করতে পারি।
ওভার ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের সাইড ইঞ্জিনিয়ার মো. রকিবুল হাসান বলেন, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল অংশে কাজ চলছে। দিনরাত পরিশ্রম করে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আমাদের কাজে সন্তুষ্ট। এখন পর্যন্ত আমাদের কর্মী বা কর্মকর্তাদের কেউ বড় ধরনের আঘাত পাননি। আশা করছি নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ হবে।
স্থানীয় বাসিন্দা শাজাহান কবির, মো: শফিকুল জানান, এখানে রেল সেতুর পাশে আমাদের জমি ছিল। ওই জমিতে উৎপাদিত ফসলে সংসার চলে না। আমরা খুব কঠিন সময় যাপন করছি। আজ এই যমুনার পাড়ে বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ায় সেতুর পাড়ে দোকান করছি। ইট বালির ব্যবসাও রয়েছে। জনপদ হওয়ায় কেউ বেকার নেই। বঙ্গবন্ধু রেলসেতু পেয়ে আমরা খুশি। এ এলাকার উন্নয়নের পাশাপাশি এখানকার বেকারত্ব দূর হবে বলে আমি মনে করি।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার নলসন্ধ্যা গ্রামের রেজাউল করিম বলেন, গাজীপুরের একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করি। ছুটিতে বাড়ি ফেরার সময় চন্দ্রা ও টাঙ্গাইল যানজটে ভোগেন। গাজীপুর থেকে বাসে উল্লাপাড়া যেতে সাধারণত আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেললাইন পার হতে সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ মিনিট। বঙ্গবন্ধু রেলসেতু চালু হলে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টায় উল্লাপাড়া পৌঁছাতে পারব। এটি আমাদের ভ্রমণকে নিরাপদ করবে এবং সময় বাঁচবে।
টাঙ্গাইল-২ (ভূঞাপুর-গোপালপুর) আসনের সংসদ সদস্য তানবীর হাসান ছোট মনির বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল টাঙ্গাইলবাসীর স্বপ্নের প্রকল্প। রেলওয়ে সেতুর উত্তর-পূর্ব পাশে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের কাজ চলছে। এখানে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এই রেলসেতুটি নির্মিত হলে যেকোনো স্থান থেকে পণ্য পরিবহন সহজ হবে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে আমাদের সংযোগকারী রেলওয়ে সেতুটি হবে একটি সেতু।
তিনি আরও বলেন, রেলসেতুর মাধ্যমে যাত্রীসেবার মান বাড়বে এবং ব্যবসারও দ্রুত প্রসার ঘটবে। এক সময় এই যমুনা পাড়ের মানুষ কষ্টে দিন কাটাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু সেতুর কারণে আজ এ এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। রেল সেতুর কাজ শেষ হলে এ এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু প্রকল্পের পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান বলেন, রেল সেতুর কাজ খুব দ্রুত এগিয়ে চলছে। প্রায় এক হাজার দেশি-বিদেশি শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করেছেন রেলসেতুটি নির্মাণে। ইতিমধ্যে রেলসেতুর ৬১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। রেল সেতু নির্মাণে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ চলছে। আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে।
No comments